সবচেয়ে কম খরচে হানিমুনের জন্য সেরা ৫টি দেশ

বিয়ের পর যে কোন নবদম্পতির ইচ্ছা থাকে দু’জন মিলে একান্তে কোথাও থেকে ঘুরে আসার। প্রচলিত ভাষায় আমরা এই ঘুরে আসাকে ‘হানিমুন’ বলে চিনি। যাই হোক, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রবল ইচ্ছা থাকার পরও দেশের বাইরে হানিমুনে যাওয়া অনেক দম্পতির পক্ষেই সম্ভব হয় না। কারণটাও খুব স্বাভাবিক, খরচ! নতুন বিয়ের পর সংসার শুরু করতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়, তার ওপর বিলাসিতা দেখাতে গিয়ে বিদেশে হানিমুনে যাওয়া অযৌক্তিক মনে হতেই পারে।

কিন্তু যে কোন দেশে বেড়াতে গেলেই যে প্রচুর খরচ হবে, এই ধারনাও ভুল। অনেক দম্পতিই কক্সবাজার, সিলেট অথবা সেন্ট-মার্টিনে হানিমুনে গিয়ে প্রচুর টাকা এমনিতেই খরচ করেন। ঠিক এর সমান, অথবা সামান্য বেশি টাকা খরচ করলেই বিদেশে হানিমুনে যাওয়া খুবই সম্ভব। তাই বলে ভাববেন না যে হানিমুনের আবেদনও কমে আসবে। আজকে এমন পাঁচটি দেশ নিয়ে কথা বলব, যে দেশগুলোয় সহজেই কম খরচে হানিমুন সেরে আসা সম্ভব। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যই শুধু নয়, এই দেশগুলোর সংস্কৃতিও অনেক বৈচিত্র্যময়, যা হানিমুনের আনন্দ বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ।


১। নেপাল



হিমালয়ের সন্তান নেপাল ভ্রমণ-পিপাসুদের কাছে স্বর্গের মত। শুধু রাজধানী কাঠমান্ডুই নয়, পাহাড়ঘেরা শহর পোখারা এবং পাতানও টুরিস্টদের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা। নেপাল ভ্রমণে গিয়ে সময় কাটানোর উপায়ের অভাব নেই। পাহাড়ে ট্রেকিং ত বটেই এছাড়াও রয়েছে হিমালয়ের ওপর প্যানারোমিক ফ্লাইট, পোখারায় অন্নপুর্না হিল স্টেশনে প্যারাগ্লাইডিং, সেটি নদীতে কায়াকিং, বারদিয়া ন্যাশনাল পার্কে জীববৈচিত্র্য দর্শন ইত্যাদি। এর সাথে ঐতিহাসিক কাঠমান্ডু শহরে সাইট-সিয়িং তো রয়েছেই।



খরচের ব্যাপারে বলতে গেলে, নেপাল পৃথিবীর সব থেকে সস্তা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ থেকে অন-এরাইভাল ভিসায় নেপালে প্রবেশ করা যায় বিধায় ভিসার জন্য আলাদা টাকাও গুনতে হবে না। ১৮ থেকে ২২ হাজার টাকার মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের রাউন্ড ট্রিপের টিকিট কাটতে পারবেন। যদি চান, তাহলে সড়কপথেও নেপাল ভ্রমণ সম্ভব, তবে সেক্ষেত্রে ভারতের ট্রানজিট ভিসা দরকার হবে। সড়কপথে যেতে খরচ হতে পারে ৫০০০ টাকার মত।



নেপালে আপনার খরচের মধ্যেই ভালো হোটেল পেয়ে যাবেন। বেশ ভালো মানের থ্রি-স্টার হোটেলে ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকার মধ্যেই ডবল বেডের রুম পাবেন। খরচ আরো কমাতে চাইলে সস্তা হোটেলও ভাড়ায় পাবেন, কিন্তু চাহিদা বেশী থাকায় আগে থেকে বুকিং দেয়া ভালো। প্রতিদিন খাবার খরচের জন্য গুনতে হবে ৩০০-৫০০ টাকা, কিন্তু আপনি বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে খেতে চাইলে অবশ্য অন্য কথা। সবমিলিয়ে হানিমুনের জন্য নেপাল খুবই আদর্শ স্থান। খরচের মধ্যেও মিলে যাবে সব।


২। ভুটান



ভুটান ভ্রমণের অন্যতম সুবিধা হচ্ছে, নেপালের মতই ভুটান যেতেও কোন ভিসার প্রয়োজন হয় না। আকাশপথে ভুটান গেলে পারো এয়ারপোর্টেই অন-এরাইভাল ভিসা পাবেন। সড়কপথে যেতে চাইলে অবশ্য আলাদা অনুমতি পত্র এবং ভারতের ট্রানজিট ভিসা দরকার হবে। নেপালের মতই ভুটানও পাহাড়ঘেরা দেশ। ভুটানে আলাদা করে দেখার জায়গার কথা বলা একটু কঠিন, কেননা ভুটানের শহরগুলোই পুরো দেখার জায়গা। ভুটানের সবথেকে বিখ্যাত পর্যটন স্থান অবশ্য মাচু-পিচু পর্বতের থাকসান মন্দির। গিরিখাদের কোলে নির্মিত এই মন্দির যে কোন ভ্রমণপিপাসুর নজর কাড়তে সক্ষম।


২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে ভুটানের রাউন্ড ট্রিপের বিমানের টিকিট পাবেন। সড়কপথে যেতে চাইলে জনপ্রতি ৩০০০ টাকা খরচ হবে। সড়কপথে ভুটান গেলে প্রথমে থিম্পু গিয়ে ওঠাই ভালো, এরপর সেখান থেকে আশে পাশের শহর ঘুরে দেখতে পারেন। থিম্পুতে বিভিন্ন মানের এবং দামের হোটেল পাবেন। খরচ কমাতে চাইলে প্রতি রাত ৫০০ টাকায়ই হোটেলে কামরা পেয়ে যাবেন। বিলাসবহুল ৫ তারা হোটেলেও চাইলে থাকতে পারেন। সেক্ষেত্রে প্রতি রাতের জন্য খরচ হবে ৫০০০ টাকা অথবা তারও বেশি।


ভুটানে খাবার যথেষ্ট সস্তা। স্থানীয় খাবারের দোকানগুলোয় ১০০-২৫০ টাকায় দুপুরের এবং রাতের খাবার অনায়াসে শেষ করতে পারেন। তবে হ্যা, রাতের খাবারটা সারতে হবে বেশ তাড়াতাড়ি, ভুটানের মানুষ বেশ আগেই ঘুমাতে যায়। বেশি রাত পর্যন্ত দোকানপাট খোলা পাবেন না।


৩। শ্রীলংকা



রাবণ রাজার দেশ শ্রীলংকা বাংলাদেশের টুরিস্টদের কাছে এখনও তেমন একটা বিখ্যাত নয়। কিন্তু ভ্রমণ আকর্ষনের উপাদানের অভাব শ্রীলংকায় নেই। কলম্বো, ক্যান্ডি, দাম্বুলা সহ শ্রীলংকার সব প্রধাণ শহরেই দেখার মত কিছু না কিছু পাবেন। ক্যান্ডি এবং তার আশে পাশের এলাকায় দেখতে পারেন হাতিদের এতিমখানা, মালিগাওয়া বৌদ্ধাশ্রম, পাত্তিরিপুয়া টাওয়ার এবং নুয়ারা এলিয়া চা বাগান। কলম্বোয় ঐতিহাসিক এবং আধুনিক স্থাপনা দুটোই পাবেন। এছাড়া দাম্বুলার দু’হাজার বছরেরও বেশি পুরনো রক টেম্পল তো অবশ্যই দেখতে হবে। শ্রীলংকা দ্বীপরাষ্ট্র হওয়ায় সাগর সৈকতের সৌন্দর্য্য তো রয়েছেই।


শ্রীলংকায় যদি বিমানে সরাসরি যেতে চান, তাহলে জনপ্রতি ৩০০০০ টাকার মত খরচ হবে। অবশ্য সরাসরি গেলে অন-এরাইভাল ভিসা পাবেন, যা ভারত হয়ে গেলে না’ও পেতে পারেন। খরচ কমাতে চাইলে চেন্নাই হয়ে কলম্বো যাওয়া ভালো। তার জন্য ভারতের ডবল এন্ট্রি ভিসা লাগবে। কলকাতা থেকে চেন্নাই গিয়ে কলম্বোর প্লেনে উঠতে হবে, খরচ প্রায় জনপ্রতি ১০-১৫ হাজারে নেমে আসবে।



মোটামুটি মানের হোটেলে থাকতে চাইলে দু’জনের কামরার জন্য কলম্বো অথবা ক্যান্ডিতে ২-৩ হাজার টাকা গুনতে হবে। এর থেকে সস্তা হোটেলও পাবেন, কিন্তু খুঁজে নিতে হবে। খাবারের দাম যথেষ্টই সস্তা। নেপাল অথবা ভুটানের মতই ১৫০-৩০০ টাকায় পেটপুরে খেতে পারবেন। তাছাড়া বেশিরভাগ হোটেলেই সকালের নাস্তা ফ্রীতেই পাবেন। তবে চেষ্টা করবেন ভারতীয় অথবা বাঙ্গালি রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া সেরে নেয়ার। স্থানীয় শ্রীলঙ্কান খাবারে নারকেলের আধিক্য অনেক বেশি, খেতে বিস্বাদ লাগবে। এছাড়া ম্যাকডোনাল্ড’স, কেএফসির মত ফাস্টফুড চেইনও পাবেন অহরহ।


৪। ইন্দোনেশিয়া



শুধু এশিয়াই নয়, পুরো বিশ্বের পর্যটকদের কাছেই ইন্দোনেশিয়া এক বিখ্যাত নাম। ছোট ছোট অনেক দ্বীপ নিয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্র সৈকত এবং রিসোর্টের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। দেশটির অর্থনীতির মূল ভিত্তি পর্যটন হওয়ায় ইন্দোনেশিয়ার সরকারও পর্যটকদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। তাই কোন প্রকার অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই অন-এরাইভাল ভিসা পেয়ে যাবেন ৫ মিনিটের মধ্যেই।


ইন্দোনেশিয়ায় ঘুরতে যাওয়ার মত জায়গার আসলে কোন অভাব নেই। সবথেকে বেশি পর্যটক দেখা যায় অবশ্য বালি, জাভা, সুমাত্রা এবং ইয়োগাকার্তায়। জাভায় বরবদুর মন্দির, মেরাপি আগ্নেয়গিরি, সুমাত্রায় লেক তোবা, বালিতে উলুয়াতু এবং উলুন দানু বেরাতান মন্দির ইত্যাদি-সহ আরোও অনেক দর্শনীয় স্থান পুরো ইন্দোনেশিয়া জুড়েই রয়েছে। এছাড়া বিনোদনের উপকরণেরও কোন অভাব নেই। সার্ফিং থেকে শুরু করে সমুদ্রের তলদেশে স্কুবা ডাইভিং পর্যন্ত সবই করার সুযোগ মিলবে ইন্দোনেশিয়ায়।


বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার কোন ফ্লাইট নেই। সাধারণত সকল ফ্লাইটই কুয়ালালামপুর হয়ে তারপর ইন্দোনেশিয়া যায়। এজন্য অবশ্য আলাদা করে কোন ভিসার দরকার নেই। ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় রাউন্ড ট্রিপের টিকিট পাবেন।



আপনার বাজেটের ওপর নির্ভর করে থাকা আর খাওয়ার ব্যবস্থা সহজেই করতে পারবেন ইন্দোনেশিয়ায়। দৈনিক পাঁচ ডলারের বাংক যেমন এখানে আছে, তেমনি রয়েছে হাজার ডলারের রিসোর্ট এবং বাংলো। মোটামুটি মানের হোটেলে ডবল বেডের কামরা ৩০০০ টাকায় পেয়ে যাবেন। ইন্দোনেশিয়ার সী-ফুড অবশ্যই চেখে দেখতে হবে। খাবার ভেদে দাম কম-বেশি হতে পারে। দেশি খাবার খেতে চাইলে ভারতীয় রেস্টুরেন্টও পাবেন, ফাস্টফুড চেইন তো রয়েছেই তার সাথে।


৫। ভিয়েতনাম



ইন্দোনেশিয়ার মত ভিয়েতনামও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ। তবে ভিয়েতনাম দ্বীপরাষ্ট্র নয়। ইন্দোনেশিয়ার থেকে পরিচিতি কম থাকলেও ভিয়েতনাম পর্যটকদের জন্য খুবই আদর্শ। সবথেকে বড় কথা, ভিয়েতনাম পৃথিবীর সবথেকে কম খরচের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। পর্যটকদের প্রধাণ আকর্ষণ হচ্ছে রাজধানী হ্যানয় এবং ঐতিহাসিক শহর হো চি মিং সিটি। তবে এই দুই শহরের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় ভিয়েতনাম গিয়ে যে কোন এক শহরেই বেড়ানো উচিত। আপনার পকেট ভারী থাকলে অবশ্য অন্য কথা। হো চি মিং সিটিতে রয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার নিদর্শন চু চি জঙ্গলের মাটির নিচের কৃত্রিম সুরুঙ্গ, কাও দাই মন্দির, নটরডেম ক্যাথেড্রাল ইত্যাদি। হ্যানয়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ওল্ড কোয়ার্টার মার্কেট, ওপেরা হাউজ, ওয়াটার পাপেট থিয়েটার এবং হো চি মিং জাদুঘর। হ্যানয় থেকে সহজেই হা লং বে অথবা নিন বিনহ থেকে ঘুরে আসতেও পারবেন। ভিয়েতনাম দীর্ঘদিন ফরাসি কলোনি থাকায় পুরো শহর জুড়েই তার ছোঁয়া পাবেন।


বাংলাদেশে থেকে ভিয়েনাম আপনাকে বিমানেই যেতে হবে। ৩৬ থেকে ৪০ হাজার পড়বে রাউন্ড ট্রিপের টিকিটের দাম। ভিয়েতনামে যেতে চাইলে টিকিট আগে আগে কিনে রাখা ভালো, এতে করে দাম কম পড়বে। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, মালয়েশিয়ান এয়ারওয়েজ, মালিন্দো এয়ার অথবা এয়ার এশিয়ায় ভিয়েতনাম যাওয়া যাবে। হ্যা, মাঝখানে কুয়ালালামপুর অথবা সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্টে কয়েক ঘন্টার বিরতি পাবেন। ভিয়েতনামেও অন-এরাইভাল ভিসা পাওয়া যায়, তবে তার জন্য আগে থেকে আবেদন করতে হয়। আবেদন করার এক সপ্তাহের মধ্যে ভিয়েতনামে এম্বাসি অনুমতিপত্র মেইলে পাঠিয়ে দেয়। অন-এরাইভাল ভিসা পাওয়ার জন্য প্রিন্ট করে এই আবেদনপত্র নিয়ে যেতে হবে। ভিসার জন্য দিতে হবে ২০ ডলার।




আগেই বলেছি, ভিয়েতনাম পৃথিবীর অন্যতম কম খরচের দেশ। থাকা-খাওয়ার খরচ এখানে খুব অল্পেই সেরে নিতে পারবেন। দৈনিক ২০০০ টাকা খরচ করলেই বেশ ভালো মানের হোটেলে থাকতে পারবেন। খাবারের দামও অনেক সস্তা। ভিয়েতনামের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের স্ট্রিট ফুড, যার বেশিরভাগের দামই ১ ডলারের নিচে। সবই চেখে দেখার চেষ্টা করবেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক ফাস্ট ফুড চেইনগুলোর রেস্টুরেন্টও পাবেন।


দেশের বাইরে হানিমুন সেরে আসতে পারলে নব দম্পতির সংসারের সূচনাটা যেমন আনন্দদায়ক হয়, তার সাথে সাথে নতুন কোন দেশও ঘোরা হয়ে যায়। বিয়ের পরবর্তী বছরগুলোয় ব্যস্ততার কারণে সময় এবং সুযোগ অনেক কমই আসবে। তাই বিদেশে ঘুরতে যেতে চাইলে হানিমুনের সময়ই সবথেকে আদর্শ।